সুবল সরদার
সবার জননী হয়ে দেবী দুর্গা পূজিতা হন বলে তিনি সার্বজনীন। ভক্তি-শ্রদ্ধা-ভালোবাসার বাঁধনে জগৎ সৃষ্টি করেন বলে তিনি জগৎ জননী। দুর্গা পুজো শুধু বাঙালির আবেগ নয়, সারা ভারতবাসীর আবেগ। তাই বাঙালির চিরন্তন দুর্গা পুজো আমাদের জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভারত মাতা”র ছবিতো দেবী দুর্গারই রূপ, গুণের সম্মিলিত প্রতিচ্ছবি।
বাঙালির আবেগ, ভালোবাসা, পুঃনমিলন, নতুন করে ফিরে দেখার নাম দুর্গা পুজো। স্বর্গীয় কল্পনার এক জীবন্ত রূপদান হয় দুর্গা পুজো। শিল্প, সাহিত্য, কাব্যেরও এক জীবন্ত রূপ বলা যায়। মৃন্ময়ী থেকে চীন্ময়ী, দেবী থেকে মানবীর অনন্যা রূপই থেকে এই প্রতিমা শিল্পের সৃষ্টি। যিনি দেবী তিনিই মানবী! দেবীর অন্তঃসত্ত্বা কী এই মানবী!
ছোটদের কাছে পুজোর আগে পুজো আসে। পুজো মানে শুধু ছুটি আর ছুটির মজা। পুজো মানে কাশবনে বাতাসের হিল্লোল। ঢাকের ঢাক গড়গুড় আওয়াজ। পুজো মণ্ডপে বাঁশের প্যান্ডেল। রঙীন কাপড়ের কারুকার্য। আল্পনার, কল্পনার রঙে রঙিন হয়ে রাঙিয়ে তোলে মন। আমার মনে আছে স্কুল ছুটির পর বিকেলে ছুটে যেতাম বিভাসদের বৈঠকখানায়। দেখতাম সেখানে অমূল্য পোটো ঠাকুর গড়ার কাজে কেমন মনোনিবেশ করে থাকত। কত রঙের পট! হাতে তার তুলি। সহপাঠী বিভাস এদিন কানে কানে বলল সে নাকি একদিন অন্ধ হয়ে যাবে। দেবীর চক্ষু দানের মাধ্যমে তার চোখ চলে যাবে শুনে আমার খুব মন খাবার হতো। শিল্পীদের এতো কষ্ট! মানুষদের আনন্দ দিতে হয় এতো ত্যাগের বিনিময়ে! শিল্পী জীবন বলে কথা। তবুও শিল্পীর থেকে শিল্প মহান হয়, কেবল শিল্পের জন্যে শিল্প বলে? এখন পুজো আসে কিন্তু সেই আনন্দ কোথায়! মনে আছে ষষ্ঠীর দিন ভোর বেলায় মা কাঁচা শাড়ি পরতেন। তিনি ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আলপনা আঁকতেন। তখন আমাদের মাটির বাড়ি ছিল। আমি বিছানা থেকে উঠে অভাগিনী মা’র বৈধব্যের সাদা শাড়ির আচঁল ধরে বিস্ময় চোখে তাকিয়ে থাকতাম। প্রদীপ জ্বলত, শাঁখ বাজত। তখন আমার মিষ্টি অনুভূতিগুলো সুন্দর আনন্দের সঙ্গে খেলা করত। তাই এখন তখন আর এখনকার তফাৎ খুঁজে ব্যথা পেতে চাই না। তবুও পুজো আসে অতীতের সুন্দর অনুভূতিগুলো সঙ্গী করে। তাই এখন দেবী আসে সুখ-দুঃখের অনুভূতি হয়ে, হাসি-কান্নার দোলনায় চেপে।
তিনি হিমালয়ের সুদূর কৈলাস ধাম থেকে আসেন এই মর্ত্যধামে। সঙ্গে থাকে তাঁর দুই ছেলে মেয়ে -কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী এক জমজমাট সুখী সংসার। তার আসা যাওয়ার যান হয় নৌকা, দোলা, ঘোড়া, কখনও বা হাতি। তার প্রিয় বাহন সিংহ কিন্তু তাঁর যান নয়। তার মানে তিনি মঙ্গলময়ীরূপে জগতে শুধু আনন্দ দিতে চান। তিনি কখনও ‘সত্যম-শিবম-সুন্দরম’কে ধ্বংস করতে চান না। শুভ্র কৈলাসের গিরিরাজের শ্বেদ রাজপ্রাসাদ থেকে বের হয়ে তিনি সুদূর মেঘ রাজের দূর্গ অতিক্রান্ত করে দূর নীলিমার পথ ধরে সাদা মেঘের ভেলা চেপে মর্ত্যধামের কাশবনে এসে নামেন। তাঁর মা অধীর আগ্ৰহে অপেক্ষা করেন তাঁর জন্য। স্বর্গের দেবী ধরার ধরনীর পরে ধরা দেন মর্ত্যের কন্যা হয়ে। তখন তিনি দেবী নয় মানব কন্যা বলে আমরা ভাবতে শুরু করি। এইভাবে উমার আগমণ বার্তা ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে আকাশে বাতাসে। আগমনী গানে, তাঁর আসার পদধ্বনি বেজে ওঠে মহালয়ার সুরে।
আমি অবশ্য তার আগমন বার্তা পাই ঝরা শিউলি ফুলের বাতাসের গন্ধে। ছুটির বাতাসে, খুশির আনন্দে। শরতের মৃদু ঠাণ্ডা বাতাসের শিহরণে ঠিক যেন মার হাতের কোমল মিষ্টি স্পর্শে। শরতের শিশির ভেজা ঘাসে। চির সবুজ বন বিতানের ঘ্রাণে। সবুজ চোখের ভোজে, মনের সুদূর কল্পনাতে। পাল ছেঁড়া নৌকার মতো আলসে, ভবঘুরে মেঘের প্রশান্ত মুখে। নদীর কলতানে, পাখির কূজনে, বনের মর্ম্মর ধ্বনিতে। সোনালী সকালের রাঙা মনে, দিগন্তে গোধূলির বিচিত্র তুলির চিত্রিত দৃশ্যে। শতরূপার এক অনন্যা রূপে শরৎজননী হয়ে। তাই তিনি শারদীয়া, তিনিই নবপত্রিকা, কলা বউ-এর নব সংস্করণ হয়ে।
তিনি কৈলাস ছেড়ে কয়েক দিনের জন্যে আসেন এই মর্ত্যধামে পিতৃগৃহে। ষষ্ঠীর পর আসে সেই বিশেষ মহেন্দ্রক্ষন, শুরু হয় বোধন। তারপর এক এক করে আসে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী; আসে দশমী। তারপর আসে সেই বিদায়ক্ষণ। নিরঞ্জন পর শুরু হয় বিসর্জন। চোখের জলে মা ফিরে যান কৈলাসে ধামে পতিগৃহে। তিনি আসেন অসুরকে বিনাশ করে মাঙ্গলিক সুর সৃষ্টি করতে। শুভ শক্তির উত্থান হয় অশুভকে বিনাশ করে, নারী শক্তি উত্থানের মধ্যে দিয়ে। তাই তিনি হলেন দুর্গতি নাশিনী জগৎ জননী দেবী দুর্গা।
আমাদের গর্বের দুর্গা পুজো গত বছর ইউনেস্কো থেকে ওয়াল্ড হেরিটেজ স্বীকৃতি লাভ করে। আমাদের গর্ব, আবেগ, ভালোবাসা, আমাদের শিল্প, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বিশ্বজনীন হয়ে ওঠে ওয়াল্ড হেরিটেজের স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে। এটা এক বঙ্গ তনয়া অধ্যাপিকা তপতী গুহঠাকুরতার সফল প্রয়াস বলা যায়। এখন তার পথ যাত্রা শুধু কৈলাস থেকে মর্ত্যধামে নয়, বঙ্গ থেকে সারা বিশ্বে সর্বজনীন রূপে। তাই পুজো এখন শুধু সার্বজনীন নয়, বিশ্বজনীন।
ভাবি মানুষ দেবতা গড়ে না দেবতা মানুষ সৃষ্টি করে? ভাবি যে দেবতা সুর সৃষ্টি করেন তিনি কেমন করে অসুর সৃষ্টি করেন যারা তাঁর প্রিয় সৃষ্টিকে ধ্বংস করে! যে দেবী নিরীহ ভেড়া সৃষ্টি করেন তিনি কেমন করে হিংস্র সিংহ সৃষ্টি করেন! ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভ, সুর-অসুর দুটোই তাঁর সৃষ্টি। লীলাময়ীর অনন্ত লীলা খেলার মধ্যে শরৎ আসে শারদীয়াকে নিয়ে আনন্দের জোয়ারে ভেসে। তখন আনন্দে প্লাবিত হয় ধরণী। আমরা সুখের জোয়ারে ভাসি।
তার মল্লভূমি শুধু স্বর্গ নয়, নয় শুধু দানব মধুকৈটভে। শব্দ দৈত্যকে জব্দ করে দূষণমুক্ত পৃথিবী সৃষ্টি হোক মাঙ্গলিক শক্তির মধ্যে দিয়ে। এই পৃথিবী হোক তার মল্লভূমি যেখানে তিনি দানব মধুকৈটভেরূপী মানুষদেরকে বিনাশ করতে পারেন। তিনি মহাশক্তির এক মহারূপ। আদ্যাশক্তি মহামায়ার এ কী সুন্দর ভয়ংকরী রূপ! তিনি দুষ্টের দমন সৃষ্টির পালন করেন। তাই আমরা ভয়কে জয় করি অভয় মন্ত্র জপে ‘দুগ্গ দুগ্গা’ বলে। আমরা শান্তি খুঁজি দেবী আরাধনার একাগ্ৰতায়-‘নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।’