সুবল সরদার : ‘ঢাক বাজে, ঢোল বাজে, বাজে কাঁসর-ঘন্টা। আগমনীর সুর বাজে , আসে মহালয়ার পালা।’
পুজো তাদের কাছে বিষন্নতার সুর। হৃদয় ভাঙ্গার কান্না । আবার কারোর কাছে প্রেমের কবিতা । সুরের মূর্ছনায়, আলোর রোশনাই আনন্দের লহর বয়ে যায়। তাদের পুজো নেই। এঁটো- কাঁটা খেয়ে বেঁচে থাকার মতো বাসি পুজোর ও তাদের কাছে সীমাহীন আনন্দ দেয় । তাদের বোধন শুরু হয় বিসর্জনের পর । পেশার কারণে বেঁচে থাকার লড়াই করে তাদেরকে বেঁচে থাকতে হয় । অন্যদের আনন্দ, তাদের নিরানন্দ। অন্যদেরকে মনোরঞ্জন করতে তাদেরকে নিরঞ্জন নিয়ে থাকতে হয়। পুজোর গল্প হলেও তাদের ভালোবাসার গল্প কিন্তু নয় । অন্যদের ভালোবাসার গল্পগুলো তাদের দুঃখের গল্প হয়ে দুঃখীও করে তোলে না। জীবন রসে সিক্ত নয় বলে জীবনের গল্পগুলো জীবন পথের পথিক হয়ে ওঠে।
কে তারা ? কেন তাদের পুজো নেই ? তারা শিল্পী ।তারা ঢাক ,ঢোল বাজিয়ে জীবিকা অর্জন করে । তারা আমাদের বঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে জড়ো হয় শিয়ালদহ স্টেশনের কাছে পুজোর আগে । তারা এখানে কদিন ডেরা বেঁধে থাকে । শোলাঙ্কীর রাজ কন্যার বিয়ের বাসরের মতো তারা মেলা করে বসে এখানে। তারা এখানে ঢাক ,ঢোল বাজিয়ে মহড়া দেয় । নানান শারীরিক কসরৎ করে নাচের তালে ঢোল পিটিয়ে সুর তোলে। তাদের হাতের কাটি যাদু মন্ত্রের বেজে ওঠে সুরের মূর্ছনায় । এমন সুরের কার না মন গলে! ট্রেন ধারার ব্যস্ত সময়ে আটকে পড়ি এখানে, সুরের যাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। কত ঢাকি কত ঢাকে কত সুর তোলে ! কেউ বাহারি পোশাকে । কারোর ঢোলের মাথায় শাদা পালক বাঁধা । পালকে মাথায় একগুচ্ছ কালো চুল ঝোলে। কারোর সঙ্গে তাদের ছোট ছেলে । কাঁসর বাজায় বাবার সঙ্গে ঢাকের তালে তাল মিলিয়ে । ষষ্ঠীর আগে ভাড়া পেলে তারা খুশি হয় । বছরে কটা দিন মাত্র। বউ ছেলে মেয়েরা পড়ে থাকে বাড়িতে। রুদালির মতো মানুষের আনন্দ দিতে তাদের আনন্দ কখন বিক্রি হয়ে যায়। ভিড়ের মধ্যে একজনকে জিজ্ঞেস করি কি নাম ? সোমেন দাস। কোথেকে আসা হচ্ছে? মুর্শিদাবাদ। কত ভাড়া ? ৬০০০ টাকা । বাবু ,বাজাচ্ছি দেখে যান। বলতে বলতে বাজাতে শুরু করে । পেশা আর নেশা তাকে বুঁদ করে তোলে । একমাত্র কাঙাল ছাড়া ‘অভাগী’র দুঃখ কে বুঝবে ? গল্পটা এমন হলে হয়তো ভালো হতো। পুজো কদিন ভাড়া পেলে ভালো হতো ।তাদের বউ ছেলে মেয়েরা খুশি হতো। হয়তো তাদের বউ ছেলে মেয়েদের অঙ্গে নতুন শাড়ি জামা প্যান্ট উঠতো ,হোক না পুজোর পরে। যারা ভাড়া পেলো না , যারা অনেক আশা নিয়ে এসেছিল ভাড়া না পেয়ে শূন্য হাতে ফিরতে হয় বাড়িতে। বউ ছেলে মেয়ের শুকনো মুখ দেখতে বড় কষ্ট লাগে। পিতৃপক্ষ দেবীপক্ষ কী মানে তাদের কাছে ? কোথায় মহালয়া,কী তর্পণ?সব কেমন হিজিবিজি লাগে।

এমন সুরের জগৎ ছেড়ে আমাকে ফিরতে হচ্ছে ভিড়ে ঠাসাঠাসি ডায়মন্ড হারবার লোকাল ধরে । এখন মনে হচ্ছে ডিভাইন থেকে হেলে প্রবেশ করেছি । ঢাকে কাঠি পড়ে । বাতাস আগমনীর সুর ধরে । শিউলি গন্ধে বাতাস ভারী হয় । কাশের বন পুজোর ছবি আঁকে। এমন সময় পুজো আসে । শরৎ কবিতা লেখে । বাতাসে প্রথম শীতের পরিচয় ঘটে । বাতাস শিরশির করে । শিহরণ লাগে । ঘাসের রেখায় শিশির পড়ে । বন বনানী নবরূপে সাজে সবুজে । ভালোবাসার অনুভূতি কেমন আলগা হয়ে যায় । প্রবাস থেকে যদি পাওয়া যায় প্রিয়ার একটা চিঠি । সব অভিমান দূর হয় । ডুবে যাই অতীতের রাগ অনুরাগের রঙিন চেতনায় । বড় মধুর লাগে। পূজো এমন করে একটা মিলনের কাব্য হয়ে ওঠে। এসব কী তাদের চোখে ধরা দেয় ? ক্ষুধার রাজ্যে পুজো তাদের কাছে ট্রাজিক কাব্য হয়ে ওঠে ।
আজ এই শিল্পের কদর কমে গেছে। হাতে গোনা কিছু শিল্পীর জন্যে এখোনও ঢাকের বাজনা শোনা যায়। পালকির মতো তারাও হারিয়ে যেতে বসেছে এই বঙ্গ থেকে । এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্যে আমাদের দরদ কোথায় ? কোথায় আমাদের রুচি বোধ ? থিমের যুগে পূজোর কত থিম হয় । ঢাক -ঢোল আমাদের পুজোর থিম হতে পারে না ? রসিকজনদের রসবোধ কমেছে কী ? এক সময় ঢাকের তালে কোমর নাচত কিন্তু এখন কোমর নাচে ডিজের উৎকট শব্দে । এ শিল্প এখন দিশেহারা ,ভালোবাসা যখন ব্যবসা হয় । শিল্পীদের এখন পেটের টান পড়েছে । তারা নেশা ছেড়েছে এই পেশা পরিবর্তন করে । তবুও অনেকে নেশার টানে এই দুঃস্থ পেশা ধরে রেখেছে।
পুজো আসে পুজো যায় । স্মৃতি থেকে যায়। এবার ও পুজো ষষ্ঠী সপ্তমী অষ্টমী নবমী এক এক করে আসবে । দশমীর বিসর্জনে সব শেষে হবে । কিন্তু সোমেন দাসের ঢোল বাজানো ,তার হাতের যাদু কাটির সুর কখনো ভুলতে পারবো? জানি না বেচারা ভাড়া পেয়েছে কিনা। তার ঢাকের ঢাক গুড়গুড় আওয়াজে বাতাসে ভেসে আসে আমার কৈশোর। আমাদের পাশের দাস পাড়া থেকে অধিক রাত পর্যন্ত ঢাকের আওয়াজ কানে আসত। তখনও বিছানায় শুয়ে আছি জেগে। পুলকিত যামিনী ,আরব্য রজনীর নেশা ধরে । পুজোর আগে তারা ঢাক বাজিয়ে হাত সেটিং করতো কোন পুজো মণ্ডপে ভাড়া খাটার আশায় । সেই দাস পাড়া আছে কিন্তু ঢাকের আওয়াজ আর শোনা যায় না। এখন পুজো নীরবে আসে দুঃখ নিয়ে । এখন শিউলি গন্ধে,কাশের দোলে, শারদীয়ার বোধনে মন হারিয়ে যায় না । ঢাকের মিষ্টি তালে সুরের মোহে মন গলে যায় ভালোবাসার শৈশবে । এতো মিষ্টি সুর এখন কোথায় ! পুজো এলেই আমার শৈশব আসে ঢাকের মিষ্টি আওয়াজে । পুজো আসে শারদ প্রাতে ষষ্ঠীর বোধনে । আমার পুজো আসে ঢাকের তালে মনের দুয়ার প্রান্তে । তখন নষ্ট্যালজিক এর মিষ্টি অনুভূতিতে আমি মগ্ন হয়ে থাকি ।