সুবল সরদার : জলে থাকে মাছ, বনে থাক পশু, নীড়ে থাকে পাখি, প্রকৃতির সঙ্গে কীটপতঙ্গ বেঁচে থাকে ভালোবাসার নিবিড় বন্ধনে। অভিযোজন,বিবর্তন, বাস্তুতন্ত্রের স্তরে বেশ থাকে সুখে তারা। এমন সময় হঠাৎ আসে দুর্গা পুজো, সঙ্গে আসে মর্ত্যের শব্দ দৈত্য । তার পৈচাশিক তীব্র উল্লাসে ভেঙ্গে যায় তাদের সুখ নীড়। হারিয়ে যায় তাদের বেঁচে থাকার অধিকার। ভেঙ্গে যায় প্রকৃতির বিন্যাস।
কে রুখবে তাকে ? সে যে বিকৃত মনুষ্যত্বের দানব পুত্র। পুজো মানে পুজোর সময় বিকট শব্দ সৃষ্টিকারি ওই দানবীক শক্তির হাতে কয়েক দিন ধরে বন্দী থাকব আমরা। বন্দীদের দুঃখ,যন্ত্রনা, কষ্ট, কান্নার শব্দ পুজো উদ্যোক্তাদের কানে কখনো পৌঁছায় ? আইন আছে কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধে কে ? রাত ১০টার পর ৬৫ ডেসিবেলের উর্দ্ধে কখনো মাইক বাজানো যায় না। রাতে জোরে মাইক বাজানোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি আছে হাইকোর্ট থেকে। আমাদের মনে আছে কিন্তু কখনো মেনে চলি না। কে কার কথা শোনে ? কে শোনে দিনরাত বিকট শ্রুতিকটূ কান ঝালাপালা করা চটুল হিন্দি গান ? এখন পুজো কতগুলো উৎশৃঙ্খল জনতার পুজো , পুজো নয় পুজোর নামে শুধু কান ফাটানো শব্দের আরাধনা । তাদের বিকৃত রুচিবোধ নীরহ জনগণের উপর চাপিয়ে দেয় পুজোর ফ্যাশন বলে। নীরহ জনগণের নীরবে আর কত সহ্য করবে ? পুজোর নামে উচ্চ স্বরে ডিজে বাজানোর হিড়িক পড়ে যায়। তীব্র শব্দ প্রতিযোগিতায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে পুজো মণ্ডপগুলো । অবশ্য ব্যাতিক্রম আছে তবে সংখ্যায় কম । দেবী পুজো না শব্দ পুজো কোনটা আসল, পার্থক্য খোঁজা দুঃস্কর হয়ে ওঠে। এখন দুর্গা পুজো মানে শুধু শব্দ দানব ভার্সেস দেবী দুর্গা , দেবী দুর্গা ভার্সেস মহিষাসুর আর নয়।
পুজো মানে কোভিডের মতো বন্দী , কর্মহীন হয়ে বাড়িতে থাকা । লক ডাউনের মতো সব বন্ধ , ঘুম বন্ধ মাথা যন্ত্রণা নিয়ে। পুজোতে কে নিরুদ্রপে ঘুমাতে পারে ? পুজোর আনন্দ কখনো এভাবে পাওয়া যায় ? ষষ্ঠীতে শব্দ দানবের বোধন আর তার বিসর্জন হয় সেই কালী পুজোর পর। এমন তীব্র শব্দ হজম করতে করতে অভিযোজন প্রক্রিয়ায় আমাদের পাকস্থলী শক্ত হলে ভালো,অন্যথায় প্রতিমা বিসর্জনের মতো আমারও কখন গন । যদি কখনো বেঁচে থাকার বাসনা জাগে, পুজোতে শব্দ দানবকে মোকাবিলা করতে আমদেরকে হার্টের ব্যায়াম কিংবা ওষুধ সেবন করা জরুরি হয়ে পড়ে । এবারে কিন্তু পুজো মণ্ডপে জাঁকজমক করে পুজো হচ্ছে কিন্তু মাইকের দাপাদাপি নেই কেন ,বিস্ময় লাগে। রাতে ঘুম হচ্ছে । সত্যি দেবী আমাদেরকে কৃপা করেছেন। আমরা মনুষ্যত্ব ফিরে পেয়েছি শব্দ দানবকে জব্দ করে। আসলে আমাদের এখানকার প্রশাসন খুব কড়া । আইন মেনে মাইক বাজাও,অন্যথায় হাইকোর্টের শাস্তির খাঁড়া নামবে পুজো কমিটির মাথার উপর । শুনেছি গতকাল অধিক রাতে জোরকদমে মাইক বাজানোর জন্যে হরিশঙ্কর পুরের এক পুজো মণ্ডপ থেকে মাইক খুলে নিয়ে গেছে মগরাহাট থানায় । ওসির কড়া নির্দেশে কেউ জোরে মাইক বাজানোর সাহস পাচ্ছে না । পুজো যদি সবার হয় মাইকের তীব্র শব্দ কেন শুধু আমাদের হবে ? প্রসাশন সহ মগরাহাট থানার ওসিকে ধন্যবাদ জানাই। খুব সাহসী, প্রসংশনীয় কাজ। সবাই যদি এভাবে অনুসরণ করেন ,বঙ্গবাসীরা শব্দ দূষণের হাত থেকে মুক্তি পান। পুজোর বাকি দিনগুলো অষ্টমী , নবমী, দশমী ,আগামী পুজোগুলো আরো আনন্দময় হয়ে উঠুক।
আচ্ছা, বিজ্ঞান যদি মাইক আবিস্কার না করত, শান্ত সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে পারত ! বেশ হতো । তখন পুজো হতো শব্দহীন ,পরিবেশ বান্ধব, সর্বাঙ্গীন সুন্দরতম।
আমাদের মতো বন্যদের বড় মাথা নেই,তাই তাদের মাথা ব্যথার কারণও নেই। কিন্তু আমাদের মাথা যে আমাদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো আমাদের সৃষ্ট শব্দ দানব আমাদেরকে গিলে ফেলতে ছুটে আসে।
চাই না এ সর্বগ্ৰাসী নগর সভ্যতা, ফিরে যেতে চাই আমাদের সেই সবুজ অরণ্যে । কেটে যাক আমাদের দিনরাত শান্ত, ছায়াশ্রী অরণ্যে ,আসুক শান্তিতে ঘুম রাতে। পুজো হোক সবার। এ পৃথিবীর সকল প্রাণী বাঁচার অধিকার পাক ফিরে। দেবী আরাধনায় মঙ্গলময় হয়ে উঠুক আমাদের এ ধরনী।